9:37 pm, Saturday, 8 November 2025

তাদবির তাকদিরকে বদলাতে পারে না

  • Reporter Name
  • Update Time : 10:39:16 pm, Sunday, 21 September 2025
  • 53 Time View

হযরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী [রহ.]

এমনিভাবে অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় মানুষ যে ইলম লাভ করছে, তাকেও মূর্খতাই বলতে হবে। এর থেকে মানুষের ইয়াকিন সরিয়ে আল্লাহর ইলমের প্রতি ইয়াকিন তৈরি করতে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অন্যসব ইলমকে নাকচ করে দেয় এবং আল্লাহর ইলমকে প্রতিষ্ঠা করে। না জানাকেই মূর্খতা বলা হয় না; বরং বাস্তবতার বিপরীত জানাকেও মূর্খতা বলা হয়। যেমন কেউ যদি বকরীকে বাঘ মনে করে আর বাঘকে কবরী মনে করে, তাও মূর্খতাই। সমস্ত মানুষের জানাকে আল্লাহ মূর্খতা আখ্যা দিয়েছেন। যেই ইলমের উৎস আল্লাহর জাত, তাই প্রকৃত ইলম। যেই ইলম তাঁর জাত থেকে উৎসারিত হয়ে তাঁর কিতাবসমূহে স্থান পেয়েছে, তাই প্রকৃত ইলম।”

نحمده ونصلي على رسوله الكريم

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حيُوةٌ طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُوْنَ

অর্থ: যে ব্যক্তিই মুমিন থাকাবস্থায় সৎকর্ম করবে, সে পুরুহোক বা নারী, আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন যাপন করাব এবং তাদেরকে তাদের উৎকৃষ্ট কর্ম অনুযায়ী তাদের প্রতিদান অবশ্যই প্রদান করব। (সূরা নাহল: আয়াত-৯৭)

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ

অর্থ: প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৮৫)

ভাই দোস্ত-বুযুর্গ!

এই দুনিয়ায় সকল মানুষ সফলতার জন্য মেহনত করে। আল্লাহও মানুষকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন যে, তারা সফলতা অর্জন করে। মানুষ সেই ব্যক্তিকেই সফল মনে করে, যে একজন মানুষ হিসেবে তার ভেতর যেসব চাহিদা রয়েছে, সেগুলো পরণ হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলাও এটাকে সফলতা বলেন। আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মানুষকে সফলতার দিকে ডাকেন। চব্বিশ ঘণ্টায় আল্লাহ তা’আলা মানুষকে পাঁচবার সফলতার দিকে ডাকেন। মানুষের জীবনযাপনও সফলতার জন্যই এবং তার চিন্তাও সবসময় এটাই থাকে যে, কীভাবে সফলতা অর্জন করা যায়।

মুয়াযযিন আযানে حى على الفلاح বলেন। এর অর্থ- এসো সফলতার দিকে! কিন্তু আল্লাহ ও মানুষের কাছে সফলতার পরিচয় আলাদা। মানুষ তো উপস্থিত কিছু পেয়ে যাওয়া এবং নিজের চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়াকে সফলতা মনে করে। এই সফলতা অর্জনের জন্য এমন পথই বেছে নেয়, যাতে সাময়িক সফলতা অর্জন হয়। কিন্তু মানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সমস্ত সময় ও জায়গা আল্লাহর সামনে হাজির। এজন্য তিনি সাময়িক স্বার্থপূরণকে সফলতা আখ্যা দেন না। বরং প্রত্যেক জায়গায় এবং প্রত্যেক যুগে যেন আমাদের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়-এটাকেই তিনি সফলতা বলেন। আল্লাহর কাছে সফলতা বলতে সামগ্রিকতা বোঝায়। একারণেই তিনি সফলতা অর্জনের জন্য এমন পন্থাই মানুষকে অবলম্বন করতে বলেন, – যাতে করে তারা সামগ্রিক সফলতা অর্জন করতে পারে।

আমাদের যত প্রয়োজন রয়েছে এবং যেগুলো পেয়ে যাওয়াকে আমরা সফলতা মনে করি- এক্ষেত্রে আল্লাহ ও আমাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে তফাত রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য একরকম, আল্লাহর উদ্দেশ্য আরেক রকম। উদাহরণত পেটপুরে খেতে পারা এবং মান-সম্মান লাভ করা। আমরা বর্তমানে পেটপুরে খেতে পারা এবং মান-সম্মান লাভ করাকে সফলতা মনে করি। কিন্তু আল্লাহর কাছে এই সফলতার অর্থ ভিন্ন। তিনি চান, আমরা যেন সবসময় পেটপুরে খেতে পারি এবং স্থায়ীভাবে সম্মান লাভ করি। মোটকথা, আমরা উপস্থিত কিছু পেয়েই তাকে সফলতা মনে করি। আর আল্লাহ চান, আমরা যেন ভবিষ্যতেও সফলতা লাভ করতে পারি। মানুষের সফলতার মানদণ্ড নগদ লাভবান হওয়া, অথচ আল্লাহর কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। মানুষের এই ইহজাগতিক সফলতা লাভকরতে হলে তো অল্পই মেহনত করতে হয়। দুনিয়ার জীবনের সফলতাকেই কেউ যদি চরম সফলতা মনে করে এবং সে এটাকেই পেতে মেহনত করে, তাহলে তার যা ইচ্ছে করুক, এই সফলতা লাভ করুক।

কিন্তু আপনি যদি আল্লাহর বাতলে দেওয়া সফলতা অর্জন করতে চান, তাহলে আপনাকে তাঁর পথেই হাঁটতে হবে।

দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের যেসকল উপকরণ রয়েছে, মানুষ তো মৃত্যুর সময় এসব কিছুই রেখে চলে যায়। এগুলোে দিয়ে চরম সফলতা আসতে পারে না। মানুষ যদি স্থায়ী সফলতা লাভ করতে চায়, তাহলে সে দুনিয়ায় থেকে পরকালের জন্য যে মেহনত করবে, তার পুঁজি মৃত্যুর পরও তার সঙ্গে যাবে। কেউ যদি চায়, আমার সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাক এবং আমি স্থায়ীভাবে সফলতা লাভ করব, কবর ও হাশর নিরাপদে অতিক্রম করব; আমি জান্নাতে যাব, জাহান্নাম থেকে বেঁচে যাব; তাহলে তার নিজেকে গড়ে তুলতে মেহনত করতে হবে। দুনিয়ার মানুষ দু’চোখে যা দেখে, তুলতে মেহনত করতে হবে। দুনিয়ার মানুষ দু’চোখে যা দেখে, সে অনুযায়ীই নিজেকে গড়ে তুলে এবং নিজের হিসেব অনুযায়ী সফলতা অর্জন করতে চায়। এটা না করে বরং আমাদেরকে আল্লাহর দেখানো পথে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। এটাকেই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মেহনত বলা হয়। আমাদের জন্য যে মেহনত ধার্য করা হয়েছে, সেটাকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মেহনত বলা হয়। ব্যবসা, চাষাবাদ, চাকরি ও রাজত্ব ইত্যাদি দুনিয়ার মেহনতের ‘কালিমা’ (শব্দ)। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আখেরাতের মেহনতের কালিমা। এই মেহনতই সকল মেহনতের ওপর বিজয়ী হবে। এজন্যই বলা হয়েছে- وَ كَلِمَةُ الله هي العليا “আর আল্লাহর কালিমাই বিজয়ী হবে।” (সূরা তাওবা:
আয়াত-৪০) দুনিয়ায় যত প্রকারের মানুষ রয়েছে- শাসক বা শাসিত, ধনী বা গরিব; সবার মেহনত একটাই; আর তা হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মেহনত। যে এর ওপর মেহনত করবে, ভবিষ্যত তাকে এগিয়ে দেবে। আর সে সফল হবেই। রাজত্ব, সম্পদ, জায়গা-জমি ইত্যাদি পেয়ে যাওয়া সফলতা নয়। এগুলো থাকা সত্ত্বেও জীবনে ব্যর্থতা আসতে পারে। আমরা নিজেদের ভাগ্য বদলাতে মেহনত করি। এটাও এক প্রকারের মেহনত। আরেকটি মেহনত এই যে, আমরা যেই শ্রেণির মানুষ, সেই জায়গা থেকেই আমরা আখেরাতে মেহনত করব। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মেহনতকে সফল বানাতে এর জন্য কালিাম বানিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেক প্রকারের মানুষ যদি তার জায়গায় থেকে মেহনত করে, তাহলে সে সফল হতে পারে। কালিমায়ে তাইয়্যিবায় দু’টি বিষয় আছে। এক. ঈমানের মেহনত। দুই. আমলের মেহনত। ইয়াকিনও ঠিক থাকতে হবে, আমলও ঠিক থাকতে হবে। কালিমায়ে তাইয়্যিবায় দু’টি মেহনতের কথাই রয়েছে। ইয়াকিনের কালিমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ আমলের কালিমা। এর অর্থ হচ্ছে, যদি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ বেছে নাও, তাহলে এটা হবে আমলে সালেহ। মানুষ তো দেখে; কিন্তু পুরোপুরি দেখে না। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ নিজের চোখে যা দেখা যায়, তা থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে
ফেলা। এটি আমাদের
আত্মিক ব্যাধির চিকিৎসা
করে। আমরা মনে
করি, আমিই করি এবং
দুনিয়ার আসবাব থেকে
আমার সবকিছুর ব্যবস্থা
হয়। কালিমার উদ্দেশ্য হচ্ছে,
আমরা যে দেখি, এসব কিছু
থেকেই হয়, তা থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে দেওয়া। অন্তরে এই ইয়াকিন পয়দা করা, এগুলো থেকে কিছু হয় না। বরং সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। মানুষ দেখে, মানুষের পেট থেকেই মানুষের জন্ম হয়। মানুষের এই দেখা ও বিশ্বাসকে খণ্ডন করতেই কালিমা দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, মানুষ থেকে মানুষ হয় না; মানুষ তো নিজেই সৃষ্টি। আল্লাহই তাদেরকে বানিয়েছেন। সবকিছুর ওপর তাঁরই নিয়ন্ত্রণ। তিনি যখন চাইবেন, সূর্যকে পূর্বদিগন্তের পরিবর্তে পশ্চিম দিগন্ত হতে বের করবেন। তিনিই পাথর থেকে উট বের করতে পারেন। তিনি যখন যা চাইবেন, তাই হবে। বিশ্বচরাচরে যা কিছু দেখা যায়, সবকিছুতেই তাঁর কুদরতের ছোঁয়া লেগে আছে। আল্লাহর মোকাবিলায় যদি পুরো জগত চলে যায়, তাহলে তারা সবাই মিলেও তাঁর ব্যবস্থাপনায় বিন্দুসমান পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানুষের ব্যাধির প্রতিষেধক এভাবে যে, তারা মনে করে, তাদের থেকেই সবকিছু হয়, অথচ তাদের থেকে কিছুই হয় না। যাঁর থেকে হয়, তাঁকে দেখা যায় না। সবকিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। পুরো জগত তাঁর কুদরতের অধীন। তিনি যা ইচ্ছে করবেন, তাই হবে। সৃষ্টিজগত থেকে তিনি যা ঘটানোর পরিকল্পনা করবেন, তাই ঘটবে। মানুষ মনে করে, এই জগতব্যবস্থা থেকেই সবকিছুর অস্তিত্ব। এটা সে নিজের চোখেই দেখতে পায় বলে বিশ্বাস করে। সমাজব্যবস্থা, কৃষিব্যবস্থা ও ব্যবসায়ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সবকিছুকেই সে জগতেরই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন মনে করে। কালিমা আমাদেরকে একথা বলে যে, এগুলোর কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই। বরং আল্লাহই একটি ব্যবস্থা নির্ধারণ করে রেখেছেন। মানুষের ডানে-বামে দু’জন ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। (সূরা ক্বা-ফ: আয়াত-১৭) তাদেরকে হেফাযত করতে ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫০৪/০২) মেঘকে পরিচালনা করতে ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। (আল হাবাইক ফি আখবারিল মালাইক: ২৪/০১) আল্লাহর ব্যবস্থাপনা থেকেই জগতে পরিবর্তন সাধন হয়। সাত আসমান ও সাত জমিনে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা ছড়িয়ে আছে। এজন্য মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু লাভ করছে। এই ব্যবস্থাপনার অধীনেই পরিবেশ মানুষের অনুকূলে বা প্রতিকূলে যায়।

যখন মানুষের মেহনতের অনুকূলে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা কাজ করে, তখন সফলতা পরিলক্ষিত হয়। আর না হয় জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ফসল কি তোমরা ফলাও, নাকি আমি? (সূরা ওয়াকিয়া: আয়াত-৬৪) তোমাদের ফসল তোমাদের মেহনতের ফল নয়; বরং আল্লাহরই ব্যবস্থাপনাতেই হচ্ছে। এমনিভাবে দুই চোখে যত ব্যবস্থাপনা দেখা যায়, এগুলো কোনোটিই উপকার করতে পারে না; আল্লাহই উপকার করতে পারেন। আল্লাহর ব্যবস্থাপনা যদি মানুষের বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। সামুদ জাতি এভাবেই ধ্বংস হয়েছে। রাজক্ষমতা সেভাবেই ধ্বংস হয়ে যায়, যেভাবে ফেরাউনের তখতে তাউস উড়ে গেছে। জগতে যত ব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এসবকিছুকেই নাকচ করে দেয়। আল্লাহর থেকে যত ব্যবস্থাপনা আছে, এসবকিছুর প্রতি ইয়াকিন তৈরি করতে বলে।

এমনিভাবে অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় মানুষ যে ইলম লাভ করছে, তাকেও মূর্খতাই বলতে হবে। এর থেকে মানুষের ইয়াকিন সরিয়ে আল্লাহর ইলমের প্রতি ইয়াকিন তৈরি করতে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অন্যসব ইলমকে নাকচ করে দেয় এবং আল্লাহর ইলমকে প্রতিষ্ঠা করে। না জানাকেই মূর্খতা বলা হয় না; বরং বাস্তবতার বিপরীত জানাকেও মূর্খতা বলা হয়। যেমন কেউ যদি বকরীকে বাঘ মনে করে আর বাঘকে বকরী মনে করে, তাও মূর্খতাই। সমস্ত মানুষের জানাকে আল্লাহ মূর্খতা আখ্যা দিয়েছেন। যেই ইলমের উৎস আল্লাহর জাত, তাই প্রকৃত ইলম। যেই ইলম তাঁর জাত থেকে উৎসারিত হয়ে তাঁর কিতাবসমূহে স্থান পেয়েছে, তাই প্রকৃত ইলম।।

যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক তৈরি না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক ইলম অর্জন হয় না। বান্দাকে বান্দা মনে না করে শাসক মনে করলে সেটাকে মূর্খতাই বলতে হয়। মানুষ যদি মানুষকে শাসক মনে করে, তাহলে এটা তার ব্যাপার এবং এটাকে মূর্খতাই বলতে হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের মাধ্যমে আমাদের কাছে যে ইলম এসেছে, সেটাই প্রকৃত ইলম। মানুষ বিলাসী জীবনযাপন করতে চায়। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানুষের যাপিত জীবনের রীতিকে প্রত্যাখ্যান করতে শেখায়। মানুষ শুধু উপস্থিত জীবন নিয়ে চিন্তা করে। আল্লাহ যাঁকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং যাঁকে সফল বলেছেন, আমাদেরকে তাঁকেই অনুসরণ করতে হবে। মানুষ বর্তমানকে বিবেচনা করে। এটাকেই গুরুত্ব দেয়। এর জন্যই মেহনত করে।

কিন্তু কালিমা তাইয়্যিবা বলে, তোমার বর্তমানের ইয়াকিনকে অন্তর থেকে বের করে দাও। কেননা, তুমি জান না, আজ তুমি জীবিত থাকবে না মরে যাবে। তুমি বরং আখেরাতের জীবনকে সামনে রেখে চল। এমন জীবন যাপন কর, যা আখেরাতের সফলতা বয়ে আনবে। মানুষ মনে করে, তাদবির (জাগতিক মেহনত) সকল সমস্যার সমাধান করে। অথচ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তাদবিরকেই নাকচ করে দেয়। তাকদিরকে সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ একথা বলে যে, তাকদির অনুযায়ীই ফয়সালা হবে। আমাদের তাদবির তাকদিরকে বদলাতে পারে না। আমাদেরকে তাদবিরের পেছন পড়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাকদিরকে কামিয়াবির ভিত্তি মনে করতে হবে। মানুষের চোখ শুধু আজকের দিনের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। জীবনের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মৃত্যুর পর যে আবার জীবিত হতে হবে, সেই বিশ্বাসের উপর জীবনের ভিত্তি রাখতে হবে।

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সেই ঈমান ও ইয়াকিনের কালিমা এবং তা এমন ইয়াকিনের উপর মানুষকে নিয়ে আসে, আল্লাহ বান্দাদের থেকে যা চান। ঈমানদাররা কীভাবে সফলতা লাভ করবে, তিনি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেই পথ বলে দিয়েছেন। তোমরা যদি উভয়জগতে আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতরাজি লাভ করতে চাও, তাহলে অন্তরে দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস গেঁথে নাও যে, এটা শুধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমরা যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শ বানিয়ে সামনে চলতে পার, তাহলে আল্লাহর সাযাহ্য তোমাদের সঙ্গে থাকবে। আল্লাহই মানুষের কল্যাণ দিতে পারেন। কল্যাণের পথ সেটিই, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। মানুষ তার জীবনে যেসব মেহনত করে- রাজত্ব, চাষাবাদ, সুস্থতা-অসুস্থতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় ও বর্জনীয় সকল কিছু বলে দিয়েছেন। এটার নামই দ্বীন। ঈমানও শিখতে হবে এবং জীবনে এসব ক্ষেত্রে কীভাবে চলতে হবে, তাও শিখতে হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে ঈমানের জন্য এবং আল্লাহর বিধানকে জমিনে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজের মেহনত ব্যয় করেছেন। আগে ঈমানদারদের একটি দল তৈরি করেছেন। তারা আগে ঈমান শিখেছেন। অতঃপর রাসূলের আদর্শকে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তারা দুনিয়ার জীবনও যাপন করেছেন, আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের আদর্শকেও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদকে আল্লাহ তা’আলা জীবনের ভিত্তি বানাননি। বরং তাঁর নির্দেশিত পথকেই জীবনের ভিত্তি বানিয়েছেন। এই পথে আপনি ও আমি কীভাবে চলতে পারি, তার জন্য মেহনতকে অগ্রগণ্য করেছেন। যেই জিনিসে মেহনত ছেড়ে দেওয়া হয়, তার শব্দ বাকি থাকলেও হাকিকত আর বাকি থাকে না। আজ আমরা ঈমানের মেহনত ছেড়ে দিয়েছি। দুনিয়ার মেহনত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এজন্য ঈমানের শব্দ ঠিকই আছে, কিন্তু দুনিয়াই আমাদের কাছে আসল হয়ে ধরা দিয়েছে।

মেহনত ছাড়াও শব্দ থেকে যায়। কিন্তু হাকিকতে পৌছতে হলে মেহনত লাগবেই। মেহনত ছাড়াই আপনি গম শব্দটি বলে ফেলতে পারেন। কিন্তু কয়েক মাস মেহনতের পরই আপনি গমের হাকিকতে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন অর্থাৎ ফসল পাবেন। একসময় এভাবেই ঈমানের ওপর মেহনত করা হয়েছিল। দুনিয়ার সকল কিছু থেকে ইয়াকিন সরিয়ে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে ঈমানের মেহনত করেছিলেন এবং ঈমানের হাকিকতে পৌঁছেছিলেন, আজ আমাদেরকেও সেভাবেই মেহনত করতে হবে তাহলেই আমাদের অন্তরে ঈমানের প্রদীপ জ্বলে উঠবে। আর এজন্যই তিন চিল্লা লাগানোর কথা বলা হয়। ঈমানের জন্য মেহনত করা না হলে শুধু ঈমান শব্দই থেকে যায়। দিন-রাত যখন শুধু ঈমানের কথাই বলা হবে এবং এর জন্য মেহনতও করা হবে, তখন দুনিয়ায় ঈমানের ঢেউ খেলে যাবে।

আমরা অনেকেই অনেক কথা বলতে পারি। কিন্তু নিজেদের কামনা-বাসনাকে ত্যাগ করতে মানসিক শক্তির প্রয়োজন আছে। আর এজন্য মেহনত জরুরি। দুনিয়ার আসবাব থেকে বিশ্বাস সরিয়ে ঈমানকে জাগানোর মেহনত করতে হবে। দু’আও করতে হবে। এই কাজ করার পর আপনি ঈমানি বিষয় নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করুন। সময় বের করে করে পুরোদমে মেহনতে সময় দিন। আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দু’আ করুন- হে আল্লাহ! আমাদের এই ইজতিমা যেন শুধু এমন না হয় যে, কিছু কথা বলা হলো আর শোনা হলো- এর মাঝেই সীমাবদ্ধ। বরং এই ইজতিমা যেন দ্বীনকে ছড়িয়ে দেওয়ার এবং এর জন্য মেহনত শুরু করার মাধ্যম ও উপলক্ষ হয়। দু’আ ও যিকিরের প্রতি ইহতিমাম করুন। দ্বীনের ওপর চলার জন্য সংকল্প করুন। আল্লাহই সবকিছু করেন। তিনি আমাদের মেহনত দেখছেন। তিনি যখন আমাদেরকে আন্তরিকভাবে মেহনত করতে দেখবেন, তখন খুশি হয়ে হেদায়াতের দরজা খুলে দেওয়ার ফয়সালা করবেন। : (সূরাতুল ওয়াকিয়া ; আয়াত নং ৬৪)

আলোকপাত করেছেন
ইসলামি চিন্তাবিদ ও গণমাধ্যমকর্মী
শফিকুর রহমান

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

বন্যপ্রাণী ও বন রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক নিবন্ধন শুরু করল বন অধিদপ্তর

তাদবির তাকদিরকে বদলাতে পারে না

Update Time : 10:39:16 pm, Sunday, 21 September 2025

হযরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী [রহ.]

এমনিভাবে অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় মানুষ যে ইলম লাভ করছে, তাকেও মূর্খতাই বলতে হবে। এর থেকে মানুষের ইয়াকিন সরিয়ে আল্লাহর ইলমের প্রতি ইয়াকিন তৈরি করতে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অন্যসব ইলমকে নাকচ করে দেয় এবং আল্লাহর ইলমকে প্রতিষ্ঠা করে। না জানাকেই মূর্খতা বলা হয় না; বরং বাস্তবতার বিপরীত জানাকেও মূর্খতা বলা হয়। যেমন কেউ যদি বকরীকে বাঘ মনে করে আর বাঘকে কবরী মনে করে, তাও মূর্খতাই। সমস্ত মানুষের জানাকে আল্লাহ মূর্খতা আখ্যা দিয়েছেন। যেই ইলমের উৎস আল্লাহর জাত, তাই প্রকৃত ইলম। যেই ইলম তাঁর জাত থেকে উৎসারিত হয়ে তাঁর কিতাবসমূহে স্থান পেয়েছে, তাই প্রকৃত ইলম।”

نحمده ونصلي على رسوله الكريم

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حيُوةٌ طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُوْنَ

অর্থ: যে ব্যক্তিই মুমিন থাকাবস্থায় সৎকর্ম করবে, সে পুরুহোক বা নারী, আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন যাপন করাব এবং তাদেরকে তাদের উৎকৃষ্ট কর্ম অনুযায়ী তাদের প্রতিদান অবশ্যই প্রদান করব। (সূরা নাহল: আয়াত-৯৭)

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ

অর্থ: প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৮৫)

ভাই দোস্ত-বুযুর্গ!

এই দুনিয়ায় সকল মানুষ সফলতার জন্য মেহনত করে। আল্লাহও মানুষকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন যে, তারা সফলতা অর্জন করে। মানুষ সেই ব্যক্তিকেই সফল মনে করে, যে একজন মানুষ হিসেবে তার ভেতর যেসব চাহিদা রয়েছে, সেগুলো পরণ হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলাও এটাকে সফলতা বলেন। আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মানুষকে সফলতার দিকে ডাকেন। চব্বিশ ঘণ্টায় আল্লাহ তা’আলা মানুষকে পাঁচবার সফলতার দিকে ডাকেন। মানুষের জীবনযাপনও সফলতার জন্যই এবং তার চিন্তাও সবসময় এটাই থাকে যে, কীভাবে সফলতা অর্জন করা যায়।

মুয়াযযিন আযানে حى على الفلاح বলেন। এর অর্থ- এসো সফলতার দিকে! কিন্তু আল্লাহ ও মানুষের কাছে সফলতার পরিচয় আলাদা। মানুষ তো উপস্থিত কিছু পেয়ে যাওয়া এবং নিজের চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়াকে সফলতা মনে করে। এই সফলতা অর্জনের জন্য এমন পথই বেছে নেয়, যাতে সাময়িক সফলতা অর্জন হয়। কিন্তু মানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সমস্ত সময় ও জায়গা আল্লাহর সামনে হাজির। এজন্য তিনি সাময়িক স্বার্থপূরণকে সফলতা আখ্যা দেন না। বরং প্রত্যেক জায়গায় এবং প্রত্যেক যুগে যেন আমাদের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়-এটাকেই তিনি সফলতা বলেন। আল্লাহর কাছে সফলতা বলতে সামগ্রিকতা বোঝায়। একারণেই তিনি সফলতা অর্জনের জন্য এমন পন্থাই মানুষকে অবলম্বন করতে বলেন, – যাতে করে তারা সামগ্রিক সফলতা অর্জন করতে পারে।

আমাদের যত প্রয়োজন রয়েছে এবং যেগুলো পেয়ে যাওয়াকে আমরা সফলতা মনে করি- এক্ষেত্রে আল্লাহ ও আমাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে তফাত রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য একরকম, আল্লাহর উদ্দেশ্য আরেক রকম। উদাহরণত পেটপুরে খেতে পারা এবং মান-সম্মান লাভ করা। আমরা বর্তমানে পেটপুরে খেতে পারা এবং মান-সম্মান লাভ করাকে সফলতা মনে করি। কিন্তু আল্লাহর কাছে এই সফলতার অর্থ ভিন্ন। তিনি চান, আমরা যেন সবসময় পেটপুরে খেতে পারি এবং স্থায়ীভাবে সম্মান লাভ করি। মোটকথা, আমরা উপস্থিত কিছু পেয়েই তাকে সফলতা মনে করি। আর আল্লাহ চান, আমরা যেন ভবিষ্যতেও সফলতা লাভ করতে পারি। মানুষের সফলতার মানদণ্ড নগদ লাভবান হওয়া, অথচ আল্লাহর কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। মানুষের এই ইহজাগতিক সফলতা লাভকরতে হলে তো অল্পই মেহনত করতে হয়। দুনিয়ার জীবনের সফলতাকেই কেউ যদি চরম সফলতা মনে করে এবং সে এটাকেই পেতে মেহনত করে, তাহলে তার যা ইচ্ছে করুক, এই সফলতা লাভ করুক।

কিন্তু আপনি যদি আল্লাহর বাতলে দেওয়া সফলতা অর্জন করতে চান, তাহলে আপনাকে তাঁর পথেই হাঁটতে হবে।

দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের যেসকল উপকরণ রয়েছে, মানুষ তো মৃত্যুর সময় এসব কিছুই রেখে চলে যায়। এগুলোে দিয়ে চরম সফলতা আসতে পারে না। মানুষ যদি স্থায়ী সফলতা লাভ করতে চায়, তাহলে সে দুনিয়ায় থেকে পরকালের জন্য যে মেহনত করবে, তার পুঁজি মৃত্যুর পরও তার সঙ্গে যাবে। কেউ যদি চায়, আমার সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাক এবং আমি স্থায়ীভাবে সফলতা লাভ করব, কবর ও হাশর নিরাপদে অতিক্রম করব; আমি জান্নাতে যাব, জাহান্নাম থেকে বেঁচে যাব; তাহলে তার নিজেকে গড়ে তুলতে মেহনত করতে হবে। দুনিয়ার মানুষ দু’চোখে যা দেখে, তুলতে মেহনত করতে হবে। দুনিয়ার মানুষ দু’চোখে যা দেখে, সে অনুযায়ীই নিজেকে গড়ে তুলে এবং নিজের হিসেব অনুযায়ী সফলতা অর্জন করতে চায়। এটা না করে বরং আমাদেরকে আল্লাহর দেখানো পথে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। এটাকেই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মেহনত বলা হয়। আমাদের জন্য যে মেহনত ধার্য করা হয়েছে, সেটাকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মেহনত বলা হয়। ব্যবসা, চাষাবাদ, চাকরি ও রাজত্ব ইত্যাদি দুনিয়ার মেহনতের ‘কালিমা’ (শব্দ)। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আখেরাতের মেহনতের কালিমা। এই মেহনতই সকল মেহনতের ওপর বিজয়ী হবে। এজন্যই বলা হয়েছে- وَ كَلِمَةُ الله هي العليا “আর আল্লাহর কালিমাই বিজয়ী হবে।” (সূরা তাওবা:
আয়াত-৪০) দুনিয়ায় যত প্রকারের মানুষ রয়েছে- শাসক বা শাসিত, ধনী বা গরিব; সবার মেহনত একটাই; আর তা হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মেহনত। যে এর ওপর মেহনত করবে, ভবিষ্যত তাকে এগিয়ে দেবে। আর সে সফল হবেই। রাজত্ব, সম্পদ, জায়গা-জমি ইত্যাদি পেয়ে যাওয়া সফলতা নয়। এগুলো থাকা সত্ত্বেও জীবনে ব্যর্থতা আসতে পারে। আমরা নিজেদের ভাগ্য বদলাতে মেহনত করি। এটাও এক প্রকারের মেহনত। আরেকটি মেহনত এই যে, আমরা যেই শ্রেণির মানুষ, সেই জায়গা থেকেই আমরা আখেরাতে মেহনত করব। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মেহনতকে সফল বানাতে এর জন্য কালিাম বানিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেক প্রকারের মানুষ যদি তার জায়গায় থেকে মেহনত করে, তাহলে সে সফল হতে পারে। কালিমায়ে তাইয়্যিবায় দু’টি বিষয় আছে। এক. ঈমানের মেহনত। দুই. আমলের মেহনত। ইয়াকিনও ঠিক থাকতে হবে, আমলও ঠিক থাকতে হবে। কালিমায়ে তাইয়্যিবায় দু’টি মেহনতের কথাই রয়েছে। ইয়াকিনের কালিমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ আমলের কালিমা। এর অর্থ হচ্ছে, যদি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ বেছে নাও, তাহলে এটা হবে আমলে সালেহ। মানুষ তো দেখে; কিন্তু পুরোপুরি দেখে না। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ নিজের চোখে যা দেখা যায়, তা থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে
ফেলা। এটি আমাদের
আত্মিক ব্যাধির চিকিৎসা
করে। আমরা মনে
করি, আমিই করি এবং
দুনিয়ার আসবাব থেকে
আমার সবকিছুর ব্যবস্থা
হয়। কালিমার উদ্দেশ্য হচ্ছে,
আমরা যে দেখি, এসব কিছু
থেকেই হয়, তা থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে দেওয়া। অন্তরে এই ইয়াকিন পয়দা করা, এগুলো থেকে কিছু হয় না। বরং সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। মানুষ দেখে, মানুষের পেট থেকেই মানুষের জন্ম হয়। মানুষের এই দেখা ও বিশ্বাসকে খণ্ডন করতেই কালিমা দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, মানুষ থেকে মানুষ হয় না; মানুষ তো নিজেই সৃষ্টি। আল্লাহই তাদেরকে বানিয়েছেন। সবকিছুর ওপর তাঁরই নিয়ন্ত্রণ। তিনি যখন চাইবেন, সূর্যকে পূর্বদিগন্তের পরিবর্তে পশ্চিম দিগন্ত হতে বের করবেন। তিনিই পাথর থেকে উট বের করতে পারেন। তিনি যখন যা চাইবেন, তাই হবে। বিশ্বচরাচরে যা কিছু দেখা যায়, সবকিছুতেই তাঁর কুদরতের ছোঁয়া লেগে আছে। আল্লাহর মোকাবিলায় যদি পুরো জগত চলে যায়, তাহলে তারা সবাই মিলেও তাঁর ব্যবস্থাপনায় বিন্দুসমান পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানুষের ব্যাধির প্রতিষেধক এভাবে যে, তারা মনে করে, তাদের থেকেই সবকিছু হয়, অথচ তাদের থেকে কিছুই হয় না। যাঁর থেকে হয়, তাঁকে দেখা যায় না। সবকিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। পুরো জগত তাঁর কুদরতের অধীন। তিনি যা ইচ্ছে করবেন, তাই হবে। সৃষ্টিজগত থেকে তিনি যা ঘটানোর পরিকল্পনা করবেন, তাই ঘটবে। মানুষ মনে করে, এই জগতব্যবস্থা থেকেই সবকিছুর অস্তিত্ব। এটা সে নিজের চোখেই দেখতে পায় বলে বিশ্বাস করে। সমাজব্যবস্থা, কৃষিব্যবস্থা ও ব্যবসায়ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সবকিছুকেই সে জগতেরই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন মনে করে। কালিমা আমাদেরকে একথা বলে যে, এগুলোর কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই। বরং আল্লাহই একটি ব্যবস্থা নির্ধারণ করে রেখেছেন। মানুষের ডানে-বামে দু’জন ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। (সূরা ক্বা-ফ: আয়াত-১৭) তাদেরকে হেফাযত করতে ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫০৪/০২) মেঘকে পরিচালনা করতে ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। (আল হাবাইক ফি আখবারিল মালাইক: ২৪/০১) আল্লাহর ব্যবস্থাপনা থেকেই জগতে পরিবর্তন সাধন হয়। সাত আসমান ও সাত জমিনে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা ছড়িয়ে আছে। এজন্য মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু লাভ করছে। এই ব্যবস্থাপনার অধীনেই পরিবেশ মানুষের অনুকূলে বা প্রতিকূলে যায়।

যখন মানুষের মেহনতের অনুকূলে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা কাজ করে, তখন সফলতা পরিলক্ষিত হয়। আর না হয় জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ফসল কি তোমরা ফলাও, নাকি আমি? (সূরা ওয়াকিয়া: আয়াত-৬৪) তোমাদের ফসল তোমাদের মেহনতের ফল নয়; বরং আল্লাহরই ব্যবস্থাপনাতেই হচ্ছে। এমনিভাবে দুই চোখে যত ব্যবস্থাপনা দেখা যায়, এগুলো কোনোটিই উপকার করতে পারে না; আল্লাহই উপকার করতে পারেন। আল্লাহর ব্যবস্থাপনা যদি মানুষের বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। সামুদ জাতি এভাবেই ধ্বংস হয়েছে। রাজক্ষমতা সেভাবেই ধ্বংস হয়ে যায়, যেভাবে ফেরাউনের তখতে তাউস উড়ে গেছে। জগতে যত ব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এসবকিছুকেই নাকচ করে দেয়। আল্লাহর থেকে যত ব্যবস্থাপনা আছে, এসবকিছুর প্রতি ইয়াকিন তৈরি করতে বলে।

এমনিভাবে অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় মানুষ যে ইলম লাভ করছে, তাকেও মূর্খতাই বলতে হবে। এর থেকে মানুষের ইয়াকিন সরিয়ে আল্লাহর ইলমের প্রতি ইয়াকিন তৈরি করতে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অন্যসব ইলমকে নাকচ করে দেয় এবং আল্লাহর ইলমকে প্রতিষ্ঠা করে। না জানাকেই মূর্খতা বলা হয় না; বরং বাস্তবতার বিপরীত জানাকেও মূর্খতা বলা হয়। যেমন কেউ যদি বকরীকে বাঘ মনে করে আর বাঘকে বকরী মনে করে, তাও মূর্খতাই। সমস্ত মানুষের জানাকে আল্লাহ মূর্খতা আখ্যা দিয়েছেন। যেই ইলমের উৎস আল্লাহর জাত, তাই প্রকৃত ইলম। যেই ইলম তাঁর জাত থেকে উৎসারিত হয়ে তাঁর কিতাবসমূহে স্থান পেয়েছে, তাই প্রকৃত ইলম।।

যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক তৈরি না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক ইলম অর্জন হয় না। বান্দাকে বান্দা মনে না করে শাসক মনে করলে সেটাকে মূর্খতাই বলতে হয়। মানুষ যদি মানুষকে শাসক মনে করে, তাহলে এটা তার ব্যাপার এবং এটাকে মূর্খতাই বলতে হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের মাধ্যমে আমাদের কাছে যে ইলম এসেছে, সেটাই প্রকৃত ইলম। মানুষ বিলাসী জীবনযাপন করতে চায়। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানুষের যাপিত জীবনের রীতিকে প্রত্যাখ্যান করতে শেখায়। মানুষ শুধু উপস্থিত জীবন নিয়ে চিন্তা করে। আল্লাহ যাঁকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং যাঁকে সফল বলেছেন, আমাদেরকে তাঁকেই অনুসরণ করতে হবে। মানুষ বর্তমানকে বিবেচনা করে। এটাকেই গুরুত্ব দেয়। এর জন্যই মেহনত করে।

কিন্তু কালিমা তাইয়্যিবা বলে, তোমার বর্তমানের ইয়াকিনকে অন্তর থেকে বের করে দাও। কেননা, তুমি জান না, আজ তুমি জীবিত থাকবে না মরে যাবে। তুমি বরং আখেরাতের জীবনকে সামনে রেখে চল। এমন জীবন যাপন কর, যা আখেরাতের সফলতা বয়ে আনবে। মানুষ মনে করে, তাদবির (জাগতিক মেহনত) সকল সমস্যার সমাধান করে। অথচ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তাদবিরকেই নাকচ করে দেয়। তাকদিরকে সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ একথা বলে যে, তাকদির অনুযায়ীই ফয়সালা হবে। আমাদের তাদবির তাকদিরকে বদলাতে পারে না। আমাদেরকে তাদবিরের পেছন পড়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাকদিরকে কামিয়াবির ভিত্তি মনে করতে হবে। মানুষের চোখ শুধু আজকের দিনের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। জীবনের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মৃত্যুর পর যে আবার জীবিত হতে হবে, সেই বিশ্বাসের উপর জীবনের ভিত্তি রাখতে হবে।

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সেই ঈমান ও ইয়াকিনের কালিমা এবং তা এমন ইয়াকিনের উপর মানুষকে নিয়ে আসে, আল্লাহ বান্দাদের থেকে যা চান। ঈমানদাররা কীভাবে সফলতা লাভ করবে, তিনি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেই পথ বলে দিয়েছেন। তোমরা যদি উভয়জগতে আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতরাজি লাভ করতে চাও, তাহলে অন্তরে দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস গেঁথে নাও যে, এটা শুধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমরা যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শ বানিয়ে সামনে চলতে পার, তাহলে আল্লাহর সাযাহ্য তোমাদের সঙ্গে থাকবে। আল্লাহই মানুষের কল্যাণ দিতে পারেন। কল্যাণের পথ সেটিই, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। মানুষ তার জীবনে যেসব মেহনত করে- রাজত্ব, চাষাবাদ, সুস্থতা-অসুস্থতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় ও বর্জনীয় সকল কিছু বলে দিয়েছেন। এটার নামই দ্বীন। ঈমানও শিখতে হবে এবং জীবনে এসব ক্ষেত্রে কীভাবে চলতে হবে, তাও শিখতে হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে ঈমানের জন্য এবং আল্লাহর বিধানকে জমিনে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজের মেহনত ব্যয় করেছেন। আগে ঈমানদারদের একটি দল তৈরি করেছেন। তারা আগে ঈমান শিখেছেন। অতঃপর রাসূলের আদর্শকে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তারা দুনিয়ার জীবনও যাপন করেছেন, আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের আদর্শকেও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদকে আল্লাহ তা’আলা জীবনের ভিত্তি বানাননি। বরং তাঁর নির্দেশিত পথকেই জীবনের ভিত্তি বানিয়েছেন। এই পথে আপনি ও আমি কীভাবে চলতে পারি, তার জন্য মেহনতকে অগ্রগণ্য করেছেন। যেই জিনিসে মেহনত ছেড়ে দেওয়া হয়, তার শব্দ বাকি থাকলেও হাকিকত আর বাকি থাকে না। আজ আমরা ঈমানের মেহনত ছেড়ে দিয়েছি। দুনিয়ার মেহনত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এজন্য ঈমানের শব্দ ঠিকই আছে, কিন্তু দুনিয়াই আমাদের কাছে আসল হয়ে ধরা দিয়েছে।

মেহনত ছাড়াও শব্দ থেকে যায়। কিন্তু হাকিকতে পৌছতে হলে মেহনত লাগবেই। মেহনত ছাড়াই আপনি গম শব্দটি বলে ফেলতে পারেন। কিন্তু কয়েক মাস মেহনতের পরই আপনি গমের হাকিকতে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন অর্থাৎ ফসল পাবেন। একসময় এভাবেই ঈমানের ওপর মেহনত করা হয়েছিল। দুনিয়ার সকল কিছু থেকে ইয়াকিন সরিয়ে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে ঈমানের মেহনত করেছিলেন এবং ঈমানের হাকিকতে পৌঁছেছিলেন, আজ আমাদেরকেও সেভাবেই মেহনত করতে হবে তাহলেই আমাদের অন্তরে ঈমানের প্রদীপ জ্বলে উঠবে। আর এজন্যই তিন চিল্লা লাগানোর কথা বলা হয়। ঈমানের জন্য মেহনত করা না হলে শুধু ঈমান শব্দই থেকে যায়। দিন-রাত যখন শুধু ঈমানের কথাই বলা হবে এবং এর জন্য মেহনতও করা হবে, তখন দুনিয়ায় ঈমানের ঢেউ খেলে যাবে।

আমরা অনেকেই অনেক কথা বলতে পারি। কিন্তু নিজেদের কামনা-বাসনাকে ত্যাগ করতে মানসিক শক্তির প্রয়োজন আছে। আর এজন্য মেহনত জরুরি। দুনিয়ার আসবাব থেকে বিশ্বাস সরিয়ে ঈমানকে জাগানোর মেহনত করতে হবে। দু’আও করতে হবে। এই কাজ করার পর আপনি ঈমানি বিষয় নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করুন। সময় বের করে করে পুরোদমে মেহনতে সময় দিন। আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দু’আ করুন- হে আল্লাহ! আমাদের এই ইজতিমা যেন শুধু এমন না হয় যে, কিছু কথা বলা হলো আর শোনা হলো- এর মাঝেই সীমাবদ্ধ। বরং এই ইজতিমা যেন দ্বীনকে ছড়িয়ে দেওয়ার এবং এর জন্য মেহনত শুরু করার মাধ্যম ও উপলক্ষ হয়। দু’আ ও যিকিরের প্রতি ইহতিমাম করুন। দ্বীনের ওপর চলার জন্য সংকল্প করুন। আল্লাহই সবকিছু করেন। তিনি আমাদের মেহনত দেখছেন। তিনি যখন আমাদেরকে আন্তরিকভাবে মেহনত করতে দেখবেন, তখন খুশি হয়ে হেদায়াতের দরজা খুলে দেওয়ার ফয়সালা করবেন। : (সূরাতুল ওয়াকিয়া ; আয়াত নং ৬৪)

আলোকপাত করেছেন
ইসলামি চিন্তাবিদ ও গণমাধ্যমকর্মী
শফিকুর রহমান