দেশের সড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটছে, এতে মারা যাচ্ছেন ২৭ জন এবং আহত হচ্ছেন ৩৮ জন। ২০১৪ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র মিলছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
দেশের সড়ক খাতের এমন বাস্তবতায় এবার নবমবার দেশজুড়ে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য-মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি। এই দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় পর্যায় থেকে বুধবার তেজগাঁও সড়ক ভবনের পাশে র্যালি এবং পরে সড়ক ভবনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক হিসাবে বলা হয়, ২০২২ সালে সারা দেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হন ৯ হাজার ৯৫১ জন এবং আহত হন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। এসব তথ্য পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে, দুর্ঘটনার ১৪ শতাংশ বাসে, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে ২৮.৩৯ শতাংশ এবং মোটরসাইকেলে ২৪.৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো, ২. চালকের অতিরিক্ত ট্রিপ, ৩. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ৪. নজরদারি ও তদারকির অভাব এবং ৫. চালকদের অদক্ষতা। এ গবেষণা থেকে জানা যায়, সড়কে দুর্ঘটনার অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে-চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার, মাদকসেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব প্রভৃতি। এছাড়া চালকদের ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা এবং সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করা। চালকরা যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় অনেকে সড়কের চিহ্ন এবং আইনকানুন সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। অনেক ক্ষেত্রে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ বাস, মিনিবাস, ট্রাকের পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে তিন চাকার যানবাহন অর্থাৎ থ্রি-হুইলার এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বড় সমস্যা তৈরি করেছে। এসব ব্যাপারে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বাস রুট রেশনালাইজেশন করে গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগও সফলতা পায়নি। এসব ব্যর্থতার কারণে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরছে না। ফলে দুর্ঘটনা এবং হতাহত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, দেশের সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। সেজন্য দুর্ঘটনা ঘটে, সেসব কমিয়ে আনতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। এটা সফল করতে সংশ্লিষ্ট অংশীজন এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনার যত ধরনের নিয়ামক থাকা দরকার, তার সব বাংলাদেশে রয়েছে। দিনদিন এটা কমার পরিবর্তে বাড়ছে। যাদের বিষয়টি দেখা দরকার, তারা বিষয়টি দেখছে না। এ কারণে দুর্ঘটনা ও হতাহত কমছে না।
তিনি জানান, সড়কের শৃঙ্খলা দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের সড়কে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই। এজন্য এসব দুর্ঘটনা কমছে না। আগে বাসের বিপরীতে ছোট যানবাহন ছিল শুধু রিকশা। কিন্তু এখন লাফিয়ে লাফিয়ে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক বেড়েছে। এসব যানবাহন সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। এছাড়া সড়কে গাড়ি চালানোর বিষয়ে চালকদের যে ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দরকার, সেটাও নেই। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সেসব কাজ বাস্তবায়ন করছে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহণ খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের এই বিশৃঙ্খলা শক্ত হাতে দমন করতে হবে। নইলে সড়কের দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনের উপায় : পরিবহণ খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ এবং হতাহত কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে সড়কে মৃত্যুর সূচক কমে আসবে। দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলো নিরাপদ হয়ে উঠবে।
তাদের মতে, দেশে এখন প্রায় ২০ কোটি মানুষের বসবাস। আর সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি। স্বল্পপরিমাণ সড়কে বিপুলসংখ্যক যানবাহন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সবার আগে প্রয়োজন চালকদের সচেতনতা। তাদের লাইফস্টাইলে শৃঙ্খলা আনতে হবে। পাশাপাশি তাদের বিশ্বাস ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সড়কে দুর্ঘটনা কমবে। আর দুর্ঘটনা কমলে হতাহতও কমবে।
এছাড়া সড়কে চালককে রক্ষণাত্মকভাবে গাড়ি চালাতে হবে, বৃষ্টির সময় গাড়ি চালাতে অতি সাবধান থাকা, চলন্ত অবস্থায় ঘুম এলে কোথাও গাড়ি থামিয়ে একটু ন্যাপ (স্বল্পমেয়াদি ঘুম) নিতে হবে। এছাড়া গাড়ির দুপাশের আয়না এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন পেছনের ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি নিউজ ডেস্কঃ 



















