5:59 pm, Thursday, 11 September 2025

সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

  • Reporter Name
  • Update Time : 06:04:47 am, Monday, 8 September 2025
  • 23 Time View

নিউজ ডেস্কঃ ইসলাম শান্তিপ্রিয় ধর্ম এবং এর শিক্ষা অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। ইসলামের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সর্বাবস্থায় সমাজ ও দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।

পবিত্র কুরআনে সূরা হিজরের ৮৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তুমি সেসব জিনিসের প্রতি কখনো লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবে না যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে জীবনোপকরণ হিসাবে দান করেছি আর তাদের জন্য দুঃখ করো না। আর তুমি বিশ্বাসী মুমিনদের জন্য নিজের অনুগ্রহের বাহু প্রসারিত কর।’ অন্যদের আল্লাহতায়ালা যেসব স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ দান করেছেন সেগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকানো ইসলামে নিষেধ। এ নীতিগত শিক্ষা অবলম্বন করে মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। পরের ধনসম্পদ অন্যায় রূপে করায়ত্ত করার মানসিকতাকে একাধারে অনেক অশান্তির জন্ম দেয়।

আল্লাহতায়ালা কুরআনে কারিমে বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন ‘ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজিম’ অর্থাৎ-নিশ্চয় তুমি অতীব মহান চরিত্রের ওপরে অধিষ্ঠিত (সূরা কলম, আয়াত : ৪)। মহানবি (সা.) বিশ্ববাসীর নেতা ছিলেন, তথাপি তিনি নিজ স্বার্থে কোনো প্রতিশোধ নিতেন না বরং শত্রুদের সঙ্গে এবং বিধর্মীদের সঙ্গেও উত্তম ব্যবহার করেছেন। মহানবি (সা.) তার উম্মতকেও এ নির্দেশই দিয়েছেন তারাও যেন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। মহানবি (সা.)-এর অতুলনীয় জীবনাদর্শ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব যাতে আমরা সহজেই বুঝতে পারি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে তার ব্যবহার কেমন ছিল।

হজরত আবুবকর (রা.)-এর কন্যা আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মহানবি (সা.)-এর যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি মহানবি (সা.)কে জিজ্ঞেস করলাম-আমি কি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ’ (সহিহ বুখারি)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করল। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। মহানবি (সা.) বললেন, তার প্রস্রাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালতি পানি আনলেন এবং পানি প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেওয়া হলো’ (সহি বুখারি, কিতাবুল আদব)।

মহানবি (সা.)-এর আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবি (সা.)-এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব অন্যায়-অত্যাচার করা?

হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘মনে রেখ যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব’ (আবু দাউদ)। হজরত আবু বাকারা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমদ)। এছাড়া মহানবি (সা.) এটিও বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেক, যদিও সে কাফির হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)’ (মুসনাদে আহমদ)।

এছাড়া আমরা লক্ষ করি মানবসেবায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির প্রতিও মহানবি (সা.) শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন ও তাদের খেয়াল রাখতেন। একবার তাঈ গোত্রের লোকেরা মহানবি (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এতে তাদের কিছুসংখ্যক লোক বন্দি হয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে আরবের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেমের এক মেয়েও ছিল। যখন সে মহানবি (সা.)-এর কাছে বলল, সে হাতেম-তাঈর মেয়ে, এ কথা শুনে মহানবি (সা.) তার সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহার করলেন এবং তার সুপারিশক্রমে তার গোত্রের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন’ (সিরাত হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ-২২৭)।

আমরা যদি সেই সময়ের ঘটনা লক্ষ করি যখন মক্কার লোকেরা মহানবি (সা.)-এর কোনো কথাই যখন শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যখন তিনি (সা.) তায়েফ পৌঁছলেন, তখন সেখানকার নেতারা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসতে লাগল। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজি হলো না। সাধারণ লোকরাও তাদের নেতাদেরই অনুসরণ করল এবং খোদার বাণীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগল। এখানে ঘটনা সংক্ষেপ করছি, কেননা-আপনাদের সবারই এ ঘটনা জানা আছে। পরিশেষে তারা সব ভবঘুরে ছেলে ছোকরাদের একত্রিত করল। তারা প্রত্যেকেই ঝোলাভর্তি পাথরের টুকরা নিল। তারা নির্মমভাবে মহানবি (সা.)-এর ওপর পাথর মারতে থাকে। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবি (সা.)কে শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। শ্রেষ্ঠ রাসূলের দুটি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠল। তারপরও তারা ঠান্ডা হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন। এ লোকগুলো যখন তার পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন, আল্লাহর গজব না আবার তাদের ওপর পড়ে। তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কী করছে।’ একটু ভেবে দেখুন, আঘাতে জর্জরিত ও লোকদের তাড়া খেয়ে তার শরীরে চলার মতো আর শক্তি ছিল না। এত কিছুর পরও তিনি (সা.) তাদের অভিশাপ দেননি বরং তাদের জন্য দোয়াই করেছেন।

হাদিসে আছে, মুসলিম দেশে বসবাসকারী বিধর্মীদের সম্বন্ধে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যদি কোনো মুসলমান এদের হত্যা করে, তাহলে সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ হাদিস দ্বারা হজরত রাসূলে করিম (সা.) মুসলিম ও অমুসলিমের জান ও মালের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেননি। আরেক জায়গায় তিনি (সা.) বলেন, ‘বিধর্মীদের ধন-সম্পদ আমাদেরই ধন-সম্পদের মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই মূল্যবান।’ এখানেও আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, অমুসলিমদের সব ধরনের স্বাধীনতা আছে। তাদের জান, মাল ও ধর্মীয়-উপাসনালয়ের সব কিছুই মুসলমানদের জান, মাল ও ধর্মীয়-উপাসনালয়ের মতো শ্রদ্ধাস্পদ।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবন দ্বারা একথা প্রমাণ করে গিয়েছেন, ধর্মের নামে কোনো অন্যায়-অবিচার নেই। সব ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিরা ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শ্রদ্ধার বস্তু। মহানবি (সা.)-এর শিক্ষাগুলোকে আজ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। মহানবি হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সব জাতির মাঝে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

আমরা যদি মহানবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে আর একই শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই এরূপ আজিমুশ্বান নবির (সা.) ওপর লাখ লাখ দরুদ ও সালাম। ইয়া রাব্বি সাল্লি আলা নাবিয়্যেকা দায়েমান ফি হাযিহিদ্দুনিয়া ওয়া বাসিন সানী। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে বিশ্বনবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

Update Time : 06:04:47 am, Monday, 8 September 2025

নিউজ ডেস্কঃ ইসলাম শান্তিপ্রিয় ধর্ম এবং এর শিক্ষা অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। ইসলামের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সর্বাবস্থায় সমাজ ও দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।

পবিত্র কুরআনে সূরা হিজরের ৮৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তুমি সেসব জিনিসের প্রতি কখনো লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবে না যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে জীবনোপকরণ হিসাবে দান করেছি আর তাদের জন্য দুঃখ করো না। আর তুমি বিশ্বাসী মুমিনদের জন্য নিজের অনুগ্রহের বাহু প্রসারিত কর।’ অন্যদের আল্লাহতায়ালা যেসব স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ দান করেছেন সেগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকানো ইসলামে নিষেধ। এ নীতিগত শিক্ষা অবলম্বন করে মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। পরের ধনসম্পদ অন্যায় রূপে করায়ত্ত করার মানসিকতাকে একাধারে অনেক অশান্তির জন্ম দেয়।

আল্লাহতায়ালা কুরআনে কারিমে বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন ‘ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজিম’ অর্থাৎ-নিশ্চয় তুমি অতীব মহান চরিত্রের ওপরে অধিষ্ঠিত (সূরা কলম, আয়াত : ৪)। মহানবি (সা.) বিশ্ববাসীর নেতা ছিলেন, তথাপি তিনি নিজ স্বার্থে কোনো প্রতিশোধ নিতেন না বরং শত্রুদের সঙ্গে এবং বিধর্মীদের সঙ্গেও উত্তম ব্যবহার করেছেন। মহানবি (সা.) তার উম্মতকেও এ নির্দেশই দিয়েছেন তারাও যেন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। মহানবি (সা.)-এর অতুলনীয় জীবনাদর্শ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব যাতে আমরা সহজেই বুঝতে পারি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে তার ব্যবহার কেমন ছিল।

হজরত আবুবকর (রা.)-এর কন্যা আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মহানবি (সা.)-এর যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি মহানবি (সা.)কে জিজ্ঞেস করলাম-আমি কি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ’ (সহিহ বুখারি)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করল। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। মহানবি (সা.) বললেন, তার প্রস্রাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালতি পানি আনলেন এবং পানি প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেওয়া হলো’ (সহি বুখারি, কিতাবুল আদব)।

মহানবি (সা.)-এর আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবি (সা.)-এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব অন্যায়-অত্যাচার করা?

হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘মনে রেখ যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব’ (আবু দাউদ)। হজরত আবু বাকারা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমদ)। এছাড়া মহানবি (সা.) এটিও বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেক, যদিও সে কাফির হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)’ (মুসনাদে আহমদ)।

এছাড়া আমরা লক্ষ করি মানবসেবায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির প্রতিও মহানবি (সা.) শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন ও তাদের খেয়াল রাখতেন। একবার তাঈ গোত্রের লোকেরা মহানবি (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এতে তাদের কিছুসংখ্যক লোক বন্দি হয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে আরবের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেমের এক মেয়েও ছিল। যখন সে মহানবি (সা.)-এর কাছে বলল, সে হাতেম-তাঈর মেয়ে, এ কথা শুনে মহানবি (সা.) তার সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহার করলেন এবং তার সুপারিশক্রমে তার গোত্রের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন’ (সিরাত হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ-২২৭)।

আমরা যদি সেই সময়ের ঘটনা লক্ষ করি যখন মক্কার লোকেরা মহানবি (সা.)-এর কোনো কথাই যখন শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যখন তিনি (সা.) তায়েফ পৌঁছলেন, তখন সেখানকার নেতারা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসতে লাগল। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজি হলো না। সাধারণ লোকরাও তাদের নেতাদেরই অনুসরণ করল এবং খোদার বাণীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগল। এখানে ঘটনা সংক্ষেপ করছি, কেননা-আপনাদের সবারই এ ঘটনা জানা আছে। পরিশেষে তারা সব ভবঘুরে ছেলে ছোকরাদের একত্রিত করল। তারা প্রত্যেকেই ঝোলাভর্তি পাথরের টুকরা নিল। তারা নির্মমভাবে মহানবি (সা.)-এর ওপর পাথর মারতে থাকে। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবি (সা.)কে শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। শ্রেষ্ঠ রাসূলের দুটি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠল। তারপরও তারা ঠান্ডা হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন। এ লোকগুলো যখন তার পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন, আল্লাহর গজব না আবার তাদের ওপর পড়ে। তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কী করছে।’ একটু ভেবে দেখুন, আঘাতে জর্জরিত ও লোকদের তাড়া খেয়ে তার শরীরে চলার মতো আর শক্তি ছিল না। এত কিছুর পরও তিনি (সা.) তাদের অভিশাপ দেননি বরং তাদের জন্য দোয়াই করেছেন।

হাদিসে আছে, মুসলিম দেশে বসবাসকারী বিধর্মীদের সম্বন্ধে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যদি কোনো মুসলমান এদের হত্যা করে, তাহলে সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ হাদিস দ্বারা হজরত রাসূলে করিম (সা.) মুসলিম ও অমুসলিমের জান ও মালের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেননি। আরেক জায়গায় তিনি (সা.) বলেন, ‘বিধর্মীদের ধন-সম্পদ আমাদেরই ধন-সম্পদের মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই মূল্যবান।’ এখানেও আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, অমুসলিমদের সব ধরনের স্বাধীনতা আছে। তাদের জান, মাল ও ধর্মীয়-উপাসনালয়ের সব কিছুই মুসলমানদের জান, মাল ও ধর্মীয়-উপাসনালয়ের মতো শ্রদ্ধাস্পদ।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবন দ্বারা একথা প্রমাণ করে গিয়েছেন, ধর্মের নামে কোনো অন্যায়-অবিচার নেই। সব ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিরা ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শ্রদ্ধার বস্তু। মহানবি (সা.)-এর শিক্ষাগুলোকে আজ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। মহানবি হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সব জাতির মাঝে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

আমরা যদি মহানবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে আর একই শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই এরূপ আজিমুশ্বান নবির (সা.) ওপর লাখ লাখ দরুদ ও সালাম। ইয়া রাব্বি সাল্লি আলা নাবিয়্যেকা দায়েমান ফি হাযিহিদ্দুনিয়া ওয়া বাসিন সানী। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে বিশ্বনবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com